আজ বেশ ঝাড়া হাত-পা বিশ্রামের সকালেও ভোর ৪টায় ঘুম ভাঙে, জেট ল্যাগ নামের সিন্দবাদের অদৃশ্য দৈত্য কিছুটা ছাড় দিলেও এখনো নামেনি পুরোপুরি, বিছানায় উল্টাপাল্টা হবার চেয়ে বই পড়া উত্তম, এই চিন্তা থেকেই হালকা গোছের বই খুঁজছিলাম, চোখে আটকে গেল হুমায়ূন আহমেদের ভ্রমণসমগ্র, ভাবলাম আমেরিকা ভ্রমণ নিয়ে উনার লেখা বইগুলো অনেক বছর আগে পড়া, আরেকবার পড়ে ফেলি, কোন ভালো তথ্য পেতেও পারি এই দেশ নিয়ে। প্রাইমারী স্কুলে এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়ে 'হোটেল গ্রেভারইন' পড়েছিলাম, সে বন্ধু বইটা ছিড়ে ফেলতে চেয়েছিল কারণ সেখানে নাকি খুব অসভ্য কিছু কথা ছিল, সেকথা শুনে আরো আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম এটুকুই মনে আছে! আবারও পড়লাম বইটা, ঠিক ভ্রমণ নয়, লেখকের আমেরিকায় পিএইচ ডি করতে আসার পর সেই সময়গুলোর কাহিনী। এ যাও বা পড়া গেল, 'মে ফ্লাওয়ার' আর 'যশোহা বৃক্ষের দেশে' পড়ে রীতিমত বিরক্ত হলাম, তরতর করে পড়া যায়, এছাড়া এই তিন বই নিয়ে কিছু বলার নাই। লাভের মধ্যে জানলাম যে লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্সের ল্যাটিন কোয়ার্টারে প্রিয় একাধিক লেখক থেকেছেন জীবন পথের বাঁকে, কাজেই সেখানে যেয়ে খুঁজে বের করতে হবে কয়েকটা বাসা।
Onu Tareq
এরমাঝে ব্লুবেরী কেক ওভেন থেকে গরমাগরম বের করলেন নীলু আপু, দারুণ সুস্বাদু কেকে চেটেপুটে চা সহকারে খেয়ে গাছের ছায়ায় দোলনায় দুলতে দুলতেই মধ্যাহ্নভোজনের সময় হাজির! তার খানিক পর কাছের এক বন পার্কে হাঁটতে যাওয়া হলো, হলিউডের এক সময়ের বিখ্যাত অভিনেতা Burgess Meredith এর নামে এই পার্কের নাম রাখা হয়েছে কারণ তিনি এই এলাকাতেই থাকতেন একসময়। হাঁটার জন্য চমৎকার ট্রেইল করা আছে, দুই পাশে উঁচু উঁচু গাছ আর সবুজের বান, এমন কী বয়ে চলা জলধারাও আছে, যার শব্দ শুনে রবার্ট ফ্রষ্টের 'The Hyla Brook' কবিতার শেষ।লাইনটা বারবার মনে আসছে জলের মত ঘুরে ঘুরে কথা কইতে, " We love the things we love, for what they are"।
নিসর্গে আমাদের সাথে হাঁটার জন্য যোগ দিয়েছিলেন ক্যারোলিনা থেকে আসা শিরীন আপু, প্রায় ৪০ বছর ধরে মার্কিন দেশে আছেন, রসায়নবিদ্যার প্রফেসর, খুব চমৎকার আবৃত্তি করেন। মৃদুমন্দ বাতাস আমাদের ছুঁয়ে দিতেই তিনি বলে গেলেন বাতাসের সাথে সাথেই
"বাতাস যেতেছে বহি
তুমি কেন রহি রহি
তারি মাঝে ফেল দীর্ঘশ্বাস
সুদূরে বাজিছে বাঁশী
তুমি কেন ঢালো আসি
তারই মাঝে বিলাপ উচ্ছাস।
উঠিছে প্রভাত রবি
আকিঁছে সোনার ছবি
তুমি কেন ফেলো তাহে ছায়া
বারেক যে চলে যায়
কেহ তো তারে না চায়
তবু কেন তার এত মায়া!
পথের ধারে দারুণ এক সাদা ফুলের গাছ, দেখতে অনেকটা চালতা ফুলের মতোই, কিন্তু অনেক ছোট। আর সেই ফুলের গন্ধ? সুগন্ধ শব্দটা নেহাতই খেলো শোনায় তার জন্য, সেন্ট না, একে বলা যায় অ্যারোমা বা ফ্রাগরেন্স। জানলাম এই সুগন্ধীর নাম 'সসার ম্যাগনোলিয়া', মানে পিরিচের মতো বড় বড়
ম্যাগনোলিয়া। এর মাঝে জীবনে প্রথম সামনাসামনি দেখা মিললো কাঠবেড়াল জাতীয় প্রাণী চিপ মানকের (Chip munk), বড্ড বেশী কিউট, তার মাঝে যখন গালে খাবার জমিয়ে মুখ-গাল ফুলিয়ে রাখা সে এক দেখার মতো, মন ভালো করার মতো দৃশ্যই বটে। শিরীন আপুকে বলতেই উনি আবারও আশ্রয় নিলেন রবি ঠাকুরে-
"তোমার কাছে চাই নি কিছু,
জানাই নি মোর নাম--
তুমি যখন বিদায় নিলে
নীরব রহিলাম।
--
যখন তুমি শুধালে নাম
পেলেম বড়ো লাজ,
তোমার মনে থাকার মতো
করেছি কোন্ কাজ।
তোমায় দিতে পেরেছিলেম
একটু তৃষার জল,
এই কথাটি আমার মনে
রহিল সম্বল।
কুয়ার ধারে দুপুরবেলা
তেমনি ডাকে পাখি,
তেমনি কাঁপে নিমের পাতা--
আমি বসেই থাকি।"
এই মানুষটা কেন এত্ত এত্ত পাগল করা লাইন লিখে গেছেন?
Onu Tareq
বিকেলে একটু তাড়া ছিল সবাই মিলে নিউইয়র্কে আয়োজিত বাংলা বইমেলায় যাবার জন্য, যেখানে সন্ধ্যায় যেয়ে দেখা হলো অনেক পরিচিত এবং অপরিচিত কিন্তু জানা মুখের সাথে, বিশেষ করে যে জমকালো গোফ থাকলে সারা ঘর আলো হয়ে থাকে আর হাসির গমকে গমগম করতে থাকে সেই গোফ জোড়ার মালিক অতি প্রিয় মানুষ লুৎফর রহমান রিটন ভাইয়ের সাথে, দেখা হওয়া মাত্রই জড়িয়ে ধরিয়ে বললেন, " আরেহ মিয়াঁ, তোমগো হাত থিকা কোথাও গিয়া রেহাই নাই দেখি!" বেশ ভীড় বইমেলায়, আর অনেক অনেক বই। ভালো লাগলো বাংলা বইকে কেন্দ্র করে এত্ত মানুষের সমাগম দেখে। সাংবাদিক-লেখক বন্ধু পারমিতা হিমের সাথে বইমেলাতেই দেখা হয় ঘুরে-ফিরে, এখানেও তার ব্যত্যয় হলো না, নিজের উপন্যাস 'নারগিস' এর বুক সাইনিং ইভেন্টে সে এসেছে এই মেলাতে এবং ওয়াশিংটন ডিসির বইমেলাতেও যাবে।
আরেক তলায় নাটক হচ্ছিল তখন, পরে আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ স্যারের বক্তৃতা, যার উপস্থাপনায় ছিলেন আহমেদ মাযহার ভাই। তার খানিক পরেই রিটন ভাইকে রীতিমত কিডন্যাপ করে নিয়ে বের হলাম রাতের খাবারের জন্য, তার পরের গন্তব্য - ম্যানহাটনের টাইমস স্কয়ার।
টাইমস স্কয়ার এক বিস্ময়, এতো ঝলমলে আলো, এত সরব শব্দ, এত মানুষের ভিড়ভিড়ি, অথচ মনে হলো এগুলো ছাড়া এই স্থান সম্পূর্ণ হতো না।
এখানের প্রতিটা মানুষ আলাদা আলাদা গল্প, কাহিনীর জন্ম হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডেই- এক চুম্বনরত জুটিকে ঘিরে দেখি জনতার ভীড় ও হাততালি চলছে, শুনলাম তারা কেবলই এনগেজড হয়েছে, তাই এই উদযাপন।
Onu Tareq
বেশ কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর সাথে দেখা যাদের প্রত্যেকেই শাড়ী পরে আছে! জানা গেল এটা তাদের ১৬ বছরে পা দেওয়ার উদযাপন, এবং বলিউড থিমের জন্য এই শাড়ী-পোশাক!
এর মাঝে নিজেই গল্প হয়ে উপস্থিত হলেন পুরনো বন্ধু সালমান নিবিড়, ম্যানহাটনেই তার বর্তমান কাজের জায়গা, শোনালেন তার প্রবাসী জীবনের গল্প।
ব্যক্তিগত ভাবে ভীড় ভাট্টা এড়িয়ে চলি, হট্টগোলও। কিন্তু এই একটা জায়গায় মনে হলো- এগুলো না থাকলে এখানের প্রাণপাখি থাকবে না!